নুসরাত হত্যার আড়ালে ২৫, বাস্তবায়নে ৫ সহপাঠী

  প্রকাশিত হয়েছেঃ  11:21 AM, 15 April 2019

মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যায় প্রায় ২৫ জন জড়িত রয়েছেন। তাকে হত্যায় শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা বাস্তবায়ন করেছেন নুসরাতেরই পাঁচ সহপাঠী। আদালতে আসামিদের দেওয়া জবানবন্দিতে এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও আইনজীবীদের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত পাঁচ জন সহ এখন পর্যন্ত মোট ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

নুসরাত হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ জন হলেন- শাহাদাত হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেন, উম্মে সুলতানা পপি ও কামরুন নাহার মনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন পিবিআই।

এদিকে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মুহম্মদ শরীফকে গ্রেফতার করেছেন পিবিআই। বুধবার (১৭ এপ্রিল) সকালে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন ফেনী পিবিআইয়ের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান।

এছাড়া নুসরাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত একমাত্র পলাতক আসামি হাফেজ আবদুল কাদের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি টিমের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। বুধবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকার হোসেনি দালান এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছে একটি দায়িত্বশীল সূত্র। যদিও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. শাহ আলম বলেন, আমরা এখনো এ ব্যাপারে তথ্য পাইনি। সারাদেশে এ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গ্রেফতারের জন্য পিবিআইয়ের অনেকগুলো টিম কাজ করছে।

এর আগে নুসরাত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তার তিন সহপাঠীকে গ্রেফতার করে পিবিআই। দুই সহপাঠীকে সোমবার দুই দফা অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। তার আগে গ্রেফতার করা হয় আরেক সহপাঠীকে। এরা হলেন, শামীম, পপি ওরফে শম্পা এবং কামরুন্নাহার মনি। এই নিয়ে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে মোট ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই।

তার আগে এ হত্যা মামলায় ১৫ জনকে গ্রেফতার দেখায় পিবিআই। এরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজউদ্দৌলা, কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মুকছুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, যোবায়ের হোসেন, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, মো. শামীম ও কামরুন্নাহার মনি।

মামলার এজাহারভুক্ত আটজনের মধ্যে সাত আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাফেজ আবদুল কাদের নামে এজাহারভুক্ত আরও এক আসামি পলাতক আছেন। এছাড়া গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে নুসরাতের আরেক সহপাঠী জান্নাতুল আফরোজকে আটক করে পিবিআই।

এছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ডে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনেরও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অভিযুক্ত অধ্যক্ষ নুসরাতের মায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি এসএম সিরাজের স্ত্রী সম্প্রতি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে তা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনকে দিয়েছেন।

জানা যায়, রুহুল আমিন নিজেই এসব টাকা থানা পুলিশসহ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া বিভিন্ন জনকে সরবরাহ করেন। তবে প্রাথমিকভাবে পাওয়া এসব তথ্য চূড়ান্তভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নুসরাত হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নাম আসার পর ফেনীতে গতকাল দিনভর আলোচনায় ছিল তার নাম। গতকাল সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে তাকে দেখা যায়। সেখানে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে চলে যান রুহুল আমিন। সেখানে কার সঙ্গে কী কথা হয়েছে তার, তা জানা যায়নি।

তবে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকে খুবই বিমর্ষ দেখা গেছে। মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহল আমীন অধ্যক্ষের আস্থাভাজন ছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এসব অপকর্ম করেও পার পেয়ে যান অধ্যক্ষ সিরাজ। এসব অভিযোগ করেছেন মাদ্রাসা সাবেক বিদ্যোৎসাহী সদস্য ও সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর শেখ মামুন।

৫ মিনিটে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন পাঁচ জন

এদিকে হত্যার সঙ্গে জড়িত দুই আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেনের জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় ৪ এপ্রিল। ৫ এপ্রিল কেরোসিন কেনা হয়। আর ৬ এপ্রিল তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

জানা যায়, এদিন পরীক্ষা দিতে এলে কৌশলে মাদ্রাসার তৃতীয় তলা ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয় নুসরাতকে। এর পর কেউ পা বাঁধেন ওড়না দিয়ে, কেউ কেরোসিন ঢেলে দেন পা থেকে বুক পর্যন্ত। অন্য একজন ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন গায়ে। তারা সংখ্যায় ছিলেন পাঁচজন আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময় লেগেছে মাত্র পাঁচ মিনিট। সবই করা হয়েছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশে।

জবানবন্দিতে ঘটনার দিনের বিস্তারিত সম্পর্কে শামীম বলেন, নুসরাতকে নিয়ে পপি ছাদে উঠলে আমরা চারজন দ্রুত তার কাছে চলে যাই। এর পর মনি ও পপি ধরে ফেলে নুসরাতকে। তখন আমি নুসরাতের মুখ চেপে ধরি। জোবায়ের নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। আমরা নুসরাতকে ছাদে শুইয়ে ফেলি। আমি নুসরাতের মুখ চেপে মাথা ধরে রাখি। মনি তার বুক ধরে রাখে। পপি পা ধরে রাখে। আর জাবেদ পলিব্যাগে থাকা কেরোসিন নুসরাতের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেলে দেয়। জোবায়ের ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়।

তিনি জানান, এতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ মিনিট। ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন দিলে তা দ্রুত গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর আমি, জাবেদ ও জোবায়ের বোরকা খুলে ফেলি। আমি প্রস্রাবখানার পাশ দিয়ে বের হয়ে যাই। জাবেদ মাদ্রাসার হোস্টেলে ঢুকে যায়। মনি ও পপি ওরফে শম্পা পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়।

নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কেরোসিন ও বোরকা কিনে এনেছিল তার সহপাঠী মনি বলে তদন্ত সূত্রে জানা গেছে। মনিকে ইতোমধ্যেই পাঁচ দিনের রিমান্ড আদেশ দিয়েছেন আদালত। পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় সরাসরি অংশ নেওয়া মনিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সে কেরোসিন ও বোরকা কিনে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারে এনেছিল। মনির কাছে এই বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলে জানিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।

আগুন দিতে জেল থেকে সিরাজের নির্দেশ

নুসরাতকে হত্যা করতে জেল থেকে নির্দেশ দেন মামলার প্রধান আসামি মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নুর উদ্দিন ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। যৌন নির্যাতনের মামলা হওয়ায় আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে- এই ধরনের যুক্তি দিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ জেল থেকেই তার সাঙ্গপাঙ্গদের নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ মতো নুসরাতের গায়ে আগুন দেয় তারা। জবানবন্দিতে নুর উদ্দিন বলেছেন, এপ্রিলের ১ ও ৩ তারিখ কারাগারে আটক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখানেই নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অধ্যক্ষের পরামর্শেই নুসরাতের গায়ে আগুন ধরানো হয়।

গত ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। পরে ওই মামলায় গ্রেফতার করা হয় অধ্যক্ষকে। গ্রেফতারের এই ঘটনার পর ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম (এইচএসসি) পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গেলে সেখানে পরিকল্পিতভাবে ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শরীরে জীবন্ত আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়।

শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে কয়েকজন বোরকা পরা নারী পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। তারা জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা মামলা তুলে না নেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় পুলিশকেও জানিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ওই দিন বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অধ্যক্ষ তার অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে ছাত্রীকে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। পরে পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের লোকজন ওই ছাত্রীর গায়ে আগুন দেয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন সক্রিয় অনলাইন প্রতিনিধি। আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, অপরাধ, সংবাদ নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

আপনার মতামত লিখুন :