হাসি নিয়ে জানা-অজানা যত মজার তথ্য ও তত্ত্ব

  প্রকাশিত হয়েছেঃ  06:01 AM, 18 February 2019

পড়ন্ত বিকেলে বন্ধুবান্ধবের মুখর কোনো আড্ডা, মজার গল্পের বই, জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম, কাতুকুতু বা লাফিং গ্যাস- উৎস যা-ই হোক না কেন, হাসি আমাদের জীবনে একটা বিশাল স্থান দখল করে আছে। হা হা হা, হি হি হি, হো হো হো সহ বিচিত্র রকমের হাসিতে মুখরিত হতে ভালোবাসি আমরা সকলেই। কারো হাসি মিষ্টি হাসি, তা মনমাতানো সুর ঝংকার সৃষ্টি করে। আবার কারো হাসি যেন বজ্রনিনাদ। তবে যে যেমনভাবেই হাসুক না কেন- তাতে আনন্দ প্রকাশে কোন বাধা সৃষ্টি হয় না। জীবনের আনন্দঘন যেকোনো মুহূর্তের প্রতীক হাসি।

প্রিয়জনের একটু হাসির জন্য মানুষ কতকিছুই না করে।

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, হাসি আসলে কী? জগতে হাসির এত মাহাত্ম্য কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই এই লেখাটি।

হাসি কী?

ভেবে দেখুন, আপনি যখন হাসেন তখন কী কী ঘটনা ঘটে? হাহাহা, হো হো হো এর মতো বিচিত্র শব্দ সৃষ্টি হয়, হাত-পা নানাভাবে নাচানাচি করে, তা-ই না? তাহলে হাসির সংজ্ঞায় বলা যায়, “অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোনো উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে আমাদের শরীর যখন বিচিত্র অঙ্গভঙ্গির সাথে মুখ থেকে এক ধরনের ছন্দময় ধ্বনি নিঃসরণ করে, তখন তাকে হাসি বলে।” এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা হাসিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, “নিঃশ্বাস ত্যাগের সাথে অনৈচ্ছিকভাবে মুখ নিয়ে নির্গত ছন্দময় ধ্বনি।”

হাসির দু’টি অংশ- শব্দ তৈরি এবং নানারকম অঙ্গভঙ্গি। মন খুলে হাসার সময় আমাদের মুখ, হাত, পা ও ধড়ের বেশকিছু মাংসপেশীর সংকোচন ঘটে। হাসিতে মুখমণ্ডলের ১৫টি পেশী অংশ নেয়। কখনো কখনো চোখ থেকে পানি ঝরে। কখনো মুখমণ্ডল লাল হয়ে যায়। এপিগ্লটিস শ্বাসনালীকে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেয় বলে আমরা হাঁপাতে থাকি।

আমরা কেন হাসি?

সব মানুষই হাসতে ভালবাসে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ দিনে অন্তত ১৭ বার হাসেন। হাসিকে ঘিরে কত সার্কাস, কমেডি মুভি, টিভি শোসহ কত ধরনের শিল্পের উদ্ভব ঘটেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

মজার সব কথা বা ঘটনাই আমাদেরকে হাসায়। তাই আমরা নানাভাবে মজা পেতে ভালবাসি। সে টাকা খরচ করে কমেডি মুভি দেখেই হোক বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েই হোক।
হাসিকে আমরা সাধারণত মজার কোনো কৌতুকে সাড়া দেয়া মনে করলেও, হাসি আসলে এত সহজ নয়। হাসি মূলত একটি সামাজিক আচরণ। যখন আমরা একা থাকি তার তুলনায় মানুষের সংস্পর্শে থাকলে ৩০ গুণ বেশি হাসি। দার্শনিক জন মরিয়েল বিশ্বাস করেন, প্রাগৈতিহাসিক সময়ে সম্ভবত বিপদ থেকে মুক্তিলাভের পর স্বস্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হাসির উদ্ভব হয়েছিল। অনেক গবেষকদের মতে, হাসি হচ্ছে দু’জন মানুষের পরস্পর সম্পর্ক তৈরি ও তা মজবুত করার হাতিয়ার। একজন মানুষের সংস্পর্শে এসে আরেকজন মানুষ তখনই হাসে, যখন যে স্বচ্ছন্দ, সুখী ও নিরাপদ বোধ করে। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, কোনো একটি দলের সদস্যরা যত হাসবে, তারা পরস্পরের তত কাছে আসবে।

হাসি বিশেষজ্ঞ পিটার ডার্কস মনে করেন, হাসি হচ্ছে দ্রুত ও স্বয়ংক্রিয় একধরনের আচরণ। আমরা হাসিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। হাসি সংক্রামকও বটে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কোম্পানির বস, গোত্রপ্রধান বা পরিবার প্রধান তাদের অধীনস্থদের চেয়ে অনেক বেশি হাসিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে মরিয়লের ব্যাখ্যা হলো, “একটা দলের মধ্যে হাসি নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে দলের আবেগীয় অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা।”

তাই, বলা যায়, হাসি শুধু রসিকতায় সাড়া দিয়ে কিছু শব্দের নির্গমন নয়, বরং এটি একটি জটিল সামাজিক আচরণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাসি নিয়ে গবেষণার জন্য আস্ত একটি বিষয়ই তৈরী হচ্ছে, যাকে বলা হয় ‘হাসিবিজ্ঞান’ বা ‘জেলোটোলজি’। আমাদের জীবনে হাসির এমনিতেই অনন্য অবস্থান রয়েছে। নানান সময়ে আমরা নানান রকম হাসি হেসে থাকি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সঠিক সময়ে সঠিক হাসিকে প্রকাশ করার জন্য নানারকম হাসির ইমোটিকন বানিয়ে ভার্চুয়াল হাসিকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়!

আমরা কীভাবে হাসি?

হাসির উৎপত্তির সাথে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অঞ্চলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব হাসিসংক্রান্ত আবেগীয় সাড়াপ্রদানের সাথে জড়িত৷ মস্তিষ্কের বামদিক সংশ্লিষ্ট শব্দ বা বস্তুর গঠন বিশ্লেষণ করে।

মস্তিষ্কই ঠিক করে আমরা হাসব কিনা, হাসলে কতটুকু হাসব;

ডানদিক বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণ করে ঠিক করে, হাসাটা যৌক্তিক হবে কিনা। আর মস্তিষ্কের মোটর অংশ মস্তিষ্কের আদেশ অনুযায়ী শারীরিকভাবে হাসির কাজটা সম্পন্ন করে। লিম্বিক সিস্টেমের এমিগডালা ও হিপ্পোক্যাম্পাসও হাসির সাথে জড়িত।

মজা পেলে হাসি কেন?

মজা পেলে যে আমরা হাসি, এটা তো সবাই জানি। কিন্তু কেন মজা পাই, তা কি জানি?

কেন কোনো ব্যাপার আমাদের কাছে মজার লাগে, তা নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব আছে৷ নিচে এমনই তিনটি তত্ত্ব বা থিওরি নিয়ে আলোচনা থাকছে।

ইনকনগ্রুয়িটি থিওরি

গবেষক থমাস ভিয়েচের মতে, একটি কৌতুক তখনই মজার মনে হয়, যখন আমরা কৌতুকটির একরকম পরিণতি আশা করি কিন্তু অন্যরকম ঘটে। যখন কৌতুক শুরু হয়, তখন আমাদের মন কীভাবে তা শেষ হবে, সে সম্পর্কে একটা কিছু ধারণা করে নেয়। তখন আমাদের আবেগ ও যুক্তি যৌথভাবে অতীত অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। কিন্তু বাস্তবে কৌতুকটি যখন অন্যদিকে মোড় নেয়, তখন আমাদের চিন্তাও সেদিকে ঘুরে যায়। এই যে, কিছু একটা আশা করা হচ্ছে, কিন্তু তা ঘটছে না কিংবা মহান কিছু বলা হবে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু বলা হলো তুচ্ছ কিছু- এই ভিন্নতার ব্যাপারটি অনেকসময় হাস্যরসের উদ্রেক করে।

সুপিরিয়রিটি থিওরি

এই থিওরি অনুযায়ী, অন্যদের ভুল, বোকামি বা দুর্ভোগ দেখে আমরা হাসি।

তখন আমাদের নিজেকে ঐ অবস্থানে থাকা ব্যক্তির চেয়ে সুপিরিওর বা শ্রেষ্ঠ মনে হয় এবং আমরা ঐ অবস্থা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও নিরাপদ ভাবি। ফলে আমাদের হাসি পায়।

রিলিফ থিওরি

সিনেমার পরিচালকরা সফলভাবে এই থিওরি বহুদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন। কোনো থ্রিলার মুভির টান টান উত্তেজনাময় মুহূর্তে পরিচালক কৌশলে সঠিক সময়ে একটা কৌতুক ব্যবহার করেন। ফলে উত্তেজনা কিছুটা কমে যায় এবং দর্শক হালকা বোধ করে। বইয়ের ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে।

হাসির উপকারিতা

বহুবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। হাসি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। হাসলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন কমে যায়, ফলে স্ট্রেস কমে যায় এবং আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফোলতে পারি। হাসলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয় এবং আমাদের শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। হাসি রক্তচাপ কমায়, তাই এটি হৃৎপিন্ডের জন্যও ভালো দাওয়াই। হাসি নেতিবাচক আবেগ যেমন- রাগ, ক্ষোভ, বিষণ্ণতা প্রভৃতি হ্রাস করে। হাসির এই উপকারিতাগুলোর জন্য ডাক্তাররা আজকাল রোগীদের ‘লাফটার থেরাপি’ গ্রহণের পরামর্শ দেন। বিশ্বের নানা দেশে এই হাসি থেরাপি চর্চা করার জন্য গড়ে উঠেছে নানা ক্লাব।

ক্লাবগুলোতে নানা বয়সের মানুষেরা নিয়ম করে বিচিত্র ঢঙে হাসাহাসি করে থাকেন। পৃথিবীতে আছে হাসি দিবসও। প্রতি বছর মে মাসের প্রথম রবিবারে পালন করা হয় ‘বিশ্ব হাসি দিবস’।

২০১৯ সালে হাসি দিবস পালিত হবে মে মাসের ৫ তারিখে ।

হাসিতে এগিয়ে কারা?

বাচ্চারা অবশ্যই সবচেয়ে বেশি হাসে৷ তারা প্রতিদিনই নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করে, এতে আনন্দ পায় এবং প্রচুর হাসে। নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি হাসেন। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষেরা এমন নারীকে সঙ্গী হিসেবে পছন্দ করেন, যিনি তার রসিকতায় বেশি হাসেন। অন্যদিকে, নারীরা এমন পুরুষদের পছন্দ করেন, যারা তাদেরকে হাসিখুশি রাখবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী নয়, যারা হাসতে পারে। অন্যান্য প্রাইমেট যেমন- শিম্পাঞ্জি, কুকুর, এমনকি ইঁদুরও কাতুকুতু দিলে হাসে ।

হাসি পৃথিবী জোড়া একটি সার্বজনীন আচরণ। পৃথিবীর আরেক প্রান্তের কোনো মানুষ আপনার ভাষা হয়তো বুঝবে না, কিন্তু হাসি ঠিকই বুঝবে। সব জায়গাতেই, সব সংস্কৃতিতেই হাসি বন্ধুত্ব ও নির্ভরতার প্রতীক। তাই, হাসুন প্রাণ খুলে। নিজের জন্য, সবার জন্য!

আপনার মতামত লিখুন :