বৈশাখের ছুটিতে ঘুরে আসুন ঢাকার আশেপাশে
দিন তিনেক পরই বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। বছরের প্রথম দিনটিতে পরিবারকে নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন অনেকেই। ঘুরতে পছন্দ করেন পরিবার কিংবা বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে। কিন্তু বছরের এই দিনটাতেও কি রাজধানী ঢাকার বাতাসে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেবার জো আছে? সবখানে শুধু ভিড় আর ভিড়। দূরে কোথাও ঘুরতে যাবার ফুরসতও পান না অনেকে। তবে রাজধানী ঢাকার আশেপাশে এমন অনেক জায়গাই রয়েছে যেখানে শান্তিতে নিরিবিলি একটা দিন কাটিয়ে আসা যাবে খুবই কম খরচে। চলুন জেনে নেয়া যাক পয়লা বৈশাখে ঘুরতে যাবার মতন কয়েকটি স্থান।
জিন্দা পার্ক
শহুরে যান্ত্রিকতার একদম কাছে থেকেও শান্ত নিবিড় একটি জায়গা জিন্দা পার্ক। ঢাকা থেকে জিন্দা পার্কের দূরত্ব মাত্র ৩৭ কিলোমিটার। ঘন সবুজ পাতার ছায়ায় এখানে সহজেই জুড়িয়ে যাবে প্রাণ। জিন্দা পার্ক অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। ৫০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই পার্কটি আসলে এলাকাবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। ১৯৮৮ সাল থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এই পার্ক। এখানে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, কমিউনিটি স্কুল, নান্দনিক স্থাপত্যের একটি লাইব্রেরী, মসজিদ, ঈদগাহ, রেস্তোরা এবং ওয়াচ টাওয়ার। ৫টি সুবিশাল লেক আর দশ হাজারের বেশি গাছের সমারোহ পার্কটিকে দিয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। এখানে হরেক রকম পাখির কলকাকলী আপনার মনকে প্রশান্ত করবেই।
চোখ জুড়ানো সবুজ রয়েছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্থান জিন্দাপার্কে। (ছবি : সংগৃহীত)
জিন্দা পার্ক যেতে হলে প্রথমে চলে যান কুড়িল বিশ্বরোড। সেখান থেকে বিআরটিসি বাস চড়ে কাঞ্চন ব্রিজ নামুন। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কাঞ্চন ব্রিজের ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২৫ টাকা করে। এবার অটোতে করে বাইপাস পর্যন্ত যান। এ ক্ষেত্রে লেগুনাও ব্যবহার করতে পারেন। অটো বা লেগুনার ভাড়া প্রায় একই ২৫-৩০ টাকা। বাইপাস নামার পর হেঁটেই পৌঁছাতে পারবেন জিন্দা পার্ক। চাইলে বিকল্প উপায়েও আসতে পারেন এখানে। বাসের পরিবর্তে সিএনজি অটো রিকশা রিজার্ভ করে যেতে পারবেন। ভাড়া পড়বে ৪০০ টাকার মতন।
পার্কের প্রবেশ মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১০০ টাকা। আর অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৫০ টাকা করে। সারাদিন নিজের মনমতো ঘুরে বেড়াতে পারবেন এই পার্কে। এখানে দুপুরে খাবারের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। তাজা শাক সবজি আর মাছ দিয়ে ভোজন পর্ব সারতে পারবেন এখানে। এজন্য জনপ্রতি ২২০ থেকে ৬৭০ টাকা পর্যন্ত প্যাকেজ রয়েছে খাবারের। পরিবার নিয়ে ঢাকার কাছেই প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটানোর একটি চমৎকার জায়গা জিন্দা পার্ক।
জল জঙ্গলের কাব্য
ঢাকার অদূরে গাজীপুরের পূবাইলে অবস্থান জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টের। ৭৫ বিঘা জমির ওপর একদম গ্রামীন পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে এই রিসোর্ট। রিসোর্ট লাগোয়া একটি বিল এর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ। এখানে গেলে দেখতে পাবেন প্রচুর গাছ গাছালীর সমাহার। রয়েছে বাঁশ আর ছনের তৈরি ছোট ছোট ছাউনি। এগুলোর আবার রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। কদমতলা , বকুলতলা, বটতলা এরকম নামের এই ছাউনিগুলোতে বসলে নির্মল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যাবেই। জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টের মূল আকর্ষণ হলো এর নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানে আছে পুকুর ভরা মাছ, শাক সব্জির বাগান । যা এখানকার ভ্রমণকারীদের খাবারের জোগান দেয়। গানের আসর, দোলনা কিংবা নাগরদোলা আপনাকে অন্য একটি ভুবনে নিয়ে যাবে।
এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মোট ৫ বেলা খাবার পরিবেশন করা হয়। বিশাল আয়োজন থাকে একেকটি পরিবেশনে। খাবারের মান আর স্বাদ অতুলনীয়। বাগানের শাক সবজি, পুকুরের মাছ, হরেক রকম ভর্তা, মাটির চুলায় রান্না, ঢেঁকি ভাঙা চালের পিঠা আপনার একটা দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে যথেষ্ট। আর সারাদিন যত ইচ্ছে চা পানের সুযোগ রয়েছে জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টের পক্ষ থেকে। বিলে নেমে মাছ ধরা কিংবা পুকুরে দাপাদাপি কোন কিছুতেই বাধা নেই এখানটায়।
জল আর জঙ্গলের কাব্যে ছড়িয়ে আছে শান্তি শান্তি ভাব। (ছবি : সংগৃহীত)
এখানে দুইভাবে প্রবেশ করা যায়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এবং সকাল থেকে রাত্রিযাপনসহ পরদিন সকাল পর্যন্ত। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এখানে অবস্থান করতে জনপ্রতি খাবার খরচসহ ১৫০০ টাকা। রাত্রিযাপন করলে ৩৫০০ টাকা। তবে সঙ্গে থাকা ড্রাইভারের খরচ ৭৫০ টাকা। জল জঙ্গলের কাব্যে যাবার আগে অবশ্যই আগাম বুকিং দিয়ে যেতে হয়।
পুবাইল কলেজগেট থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টের। রাজধানীর মহাখালি বাসট্যান্ড থেকে নরসিংদী বা কালিগন্জগামী যে কোনো বাসে চড়লে ১ ঘণ্টা পর পুবাইল কলেজ গেট নামতে পারবেন। ভাড়া পড়বে ৪০ টাকা। রিকশায় করে জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে যেতে লাগবে ২০টাকা ভাড়া। জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টটি স্থানীয়দের কাছে পাইলট বাড়ি নামেই পরিচিত।
এপথ ছাড়াও জল জঙ্গলের কাব্যে যেতে সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, আজিমপুর, মহাখালী থেকে যেতে পারবেন শিববাড়ি। ভাড়া পড়বে ৭০ টাকা। শিববাড়ি থেকে রিকশা বা সিএনজিতে যাবেন ভাদুন পর্যন্ত। যা অনেকের কাছে ইছালি নামে পরিচিত। এখানেই জল জঙ্গলের কাব্য রিসোর্ট এর অবস্থান। রিকশায় যেতে ভাড়া পড়বে ৮০-১০০ টাকা।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কটি ঢাকার অতি কাছে গাজিপুরে অবস্থিত। জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের ৩,৬৯০ একর জায়গা জুড়ে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্য প্রাণীদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে পাখিশালা, অর্কিড হাউজ, লেক জোন, বোটিং, জিরাফ ফিডিং স্পট, প্রজাপতি সাফারি, এগ ওয়ার্ল্ড এবং প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রের মতন আকর্ষণীয় স্থান। সারাদিন পরিবার নিয়ে কাটিয়ে আসার মতন একটি জায়গা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। এখানে বাঘের মুক্ত বিচরণ, সিংহের খাবার সংগ্রহ কিংবা পৃথিবীর বিখ্যাত সব প্রাণীদের চলাফেরা দেখতে পারবেন প্রাণ ভরে। তবে এসব কিছুই আপনাকে দেখতে হবে গাড়িতে চড়ে। দুটি জিপ আর দুটি বাসে চড়ে দর্শনার্থীরা মুক্তভাবে বিচরণ করা বন্য প্রাণীদের অবলোকন করতে পারে। এখানে বাঘ থেকে শুরু করে আফ্রিকান চিতা, গয়াল, সাম্বার, ভাল্লুক এবং হরিণ সহ অনেক প্রাণীকেই খোলা পরিবেশে দেখতে পাবেন।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রবেশ মুখ। (ছবি : উইকিপিডিয়া)
সাফারি পার্কের ভেতরেই টাইগার রেস্তোরাঁ এবং সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁয় বসে খেতে খেতে কাঁচের ওপাশে দেখতে পাবেন সিংহ এবং বাঘের ঘুরাঘুরি। পার্কে প্রবেশ করতে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৫০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০ টাকা ফি রাখা হয়েছে। ময়মনসিংহগামী যেকোনো বাসেই যেতে পারেন বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে অল্প দূরে বাঘের বাজার নামে একটি বাজার পাওয়া যাবে। সেখানে নেমে রিকশা বা অটোরিকশায় করে ২০ টাকা ভাড়াতে সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে।
মৈনট ঘাট
মৈনট ঘাটকে ডাকা হয় মিনি কক্সবাজার নামে। ঢাকা জেলার দোহারে অবস্থিত পদ্মা নদীর এ ঘাটের একপাড়ে দোহার অন্যপাড়ে ফরিদপুর জেলা। মৈনট ঘাটের পূর্ব পাশে পদ্মার বুকে একটি বিশাল চর আছে। যা দেখলে সমদ্রের বেলাভূমির কথা মনে হয়। এ জন্যই এই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে মিনি কক্সবাজার। মৈনট ঘাট থেকে নৌকায় করে ঘোরা যায়। দরদাম করে ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যেই পেয়ে যাবেন ভালো একটি ট্রলার। যাতে করে ঘুরতে পারবেন ইচ্ছে মতন। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় দিনে দিনেই ফিরে আসা যায় আবার। আর এজন্যই শহুরে বিষাক্ত বাতাস থেকে একটু নির্মল নিঃশ্বাস নিতে এখানে ঘুরতে যেতে পারেন সপরিবারে।
নৌকায় করে ঘোরার পাশাপাশি চরের বালুকাবেলায় গিয়ে পদ্মার বিশালতা দেখে না আসলে এ ভ্রমণই বৃথা হয়ে যাবে। অবশ্য মৈনট ঘাটের আরেকটি সুখ্যাতি রয়েছে। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায় বেশ সুন্দর।
সমুদ্রের বালিয়াড়ির সাথে মিল থাকায় মৈনট ঘাটকে মিনি কক্সবাজার ডাকা হয়। ( ছবি : সংগৃহীত)
রাজধানীর গুলিস্থানের গোলাপশাহ মাজারের সামনে থেকে দোহারগামী অনেক বাস যায়। তবে সব বাসে চড়লে মৈনট ঘাট যেতে পারবেন না। মৈনটঘাট যেতে হলে যমুনা ডিলাক্স বাসটিতে চড়ে বসুন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৯০ টাকা করে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মৈনট ঘাট নামিয়ে দেবে বাস। ফেরার শেষ বাসটি মৈনট ঘাট থেকে ছাড়ে সন্ধ্যা ছয়টায়।
তবে বাসে গেলে পথে থাকা অনেক কিছুই মিস করে যাবেন। এর মধ্যে লক্ষ্মীপ্রসাদ পোদ্দারবাড়ি, জজবাড়ি, উকিলবাড়ি, কোকিলপ্যারী প্রাসাদ, আন্ধার কুঠুরি এগুলো দেখতে মাঝিরকান্দার একটু আগে কলাকোপা নামক স্থানে নামতে হবে। মৈনট ঘাটে অনেক খাবার হোটেল আছে। এইসব হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে পারেন। পদ্মার ইলিশ এবং অন্যান্য মাছ দিয়ে সেরে নিতে পারেন অল্প টাকাতেই ভুড়িভোজ। ফেরার পথে কার্তিকপুর বাজারের রণজিৎ এবং নিরঞ্জন মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে গরম গরম মিষ্টি খেতে পারেন ।
প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন অনলাইন প্রতিনিধি। লাইফস্টাইল বিষয়ক ফ্যাশন, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ, নারী, ক্যারিয়ার, পরামর্শ, এখন আমি কী করব, খাবার, রূপচর্চা ও ঘরোয়া টিপস নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।